পুলিশের উপস্থিতিতে একজন অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা দেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে : এডঃ রবীন্দ্র ঘোষ


 

চিত্রা নদীর  জনপদ নড়াইল, মাশরাফির নড়াইল, শিল্পী উদয় শংকর ও এস এম সুলতানের নড়াইলও কি ধর্মান্ধদের আখড়া হয়ে গেল? পুলিশের উপস্থিতিতে একজন নিরপরাধ অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা দেখে কারও হৃদয়ে কি রক্তক্ষরণ হচ্ছে? নিজ শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন ঘৃণ্য অপরাধ সংগঠনে শিক্ষার্থী ও ধর্মোন্মাদ জনতাকে উসকানি দিল কারা? দেশের হাজার হাজার শিক্ষকের কজন প্রতিবাদ করেছেন এই দুর্বৃত্তপনা ও একজন শিক্ষক লাঞ্ছনার? দেশে কটা মানববন্ধন বা প্রতিবাদ সমাবেশ হলো? আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনই এই ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিল?

বলছিলাম নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের কথা। তার কলেজের এক ছাত্র সাম্প্রতিক বিতর্কিত কাণ্ডে ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার পক্ষে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছে এবং অধ্যক্ষ শিক্ষার্থীটির পক্ষ নিয়েছেন এমন অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থী ও স্থানীয় কিছু মানুষ অধ্যক্ষের মোটরবাইকে আগুন ধরিয়েই ক্ষান্ত হয়নি গলায় জুতার মালাও পরিয়ে দেয়। পুলিশ ও প্রশাসনের উপস্থিতিতেই! সে ভিডিও ও ছবি সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ঘুরছে। ধর্মের জিগিরে আর হুজুগে দিন দিন একটা ধর্মান্ধ, অমানুষ আর ইতরের দেশ যেন গড়ে তুলছি আমরা। নড়াইল মির্জাপুরের এই ঘটনা বড় অশনি সংকেত দেয়। শিক্ষক শ্যামল কান্তি থেকে হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল-আমোদিনী পাল-সুনীল চন্দ্র দাসের পর অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস একই খেলার শিকার। উগ্রবাদীরা কি হিন্দু শিক্ষকদের বিশেষ করে টার্গেট করেছে? চাচ্ছে দেশটা হিন্দু-শিক্ষকশূন্য করে ফেলতে? সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় এদেশ থেকে যত শিক্ষক আর চিকিৎসক চলে গিয়েছিলেন সেই শূন্যতা আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি এই দেশ। অথচ এদেশে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে বাঙালি মুসলমানের চেয়ে হিন্দু দানশীল জমিদার ও শিক্ষকদের দান কোনো অংশ কম নয় বরং অনেকক্ষেত্রেই বেশি।

সিলেট ও আসাম অঞ্চলের উচ্চশিক্ষার সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিষ্ঠান মুরারিচাঁদ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন-- রাজা গিরীশ চন্দ্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও পূর্বে ১৮৯২ সালে তিনি নিজের বিশাল ভূসম্পত্তির ওপর শুধু মুরারিচাঁদ কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেননি ১৮৮৬ সালে সিলেট শহরে রাজা গিরিশ চন্দ্র হাই স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন।

ময়মনসিংহে বাঙালি শিক্ষাবিদ ও সমাজসংস্কারক আনন্দমোহন বসু ১৮৮৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ময়মনসিংহ ইনস্টিটিউশন যা কালক্রমে আনন্দমোহন কলেজ হিসেবে পরিচিত হয়। বরিশালে ১৮৮৯ সালে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী অশ্বিনীকুমার প্রতিষ্ঠা করেন ব্রজমোহন কলেজ।

১৯০২ সালের জুলাই মাসে খুলনায় শিক্ষানুরাগী শ্রী ব্রজলাল চক্রবর্তী (শাস্ত্রী) প্রতিষ্ঠা করেন বিএল কলেজ। ১৯১৫ সালে অম্বিকাচরণ মজুমদারের উদ্যোগে ফরিদপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজেন্দ্র কলেজ, যশোরের মাইকেল মধুসূদন কলেজ।

টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরে বাংলাদেশের নামকরা একটি নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান 'ভারতেশ্বরী হোমস' প্রতিষ্ঠা করেন দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা। ঢাকায় জগন্নাথ কলেজ (বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জগন্নাথ হল প্রতিষ্ঠায়ও বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর অবদান জানা যায়। এদেশে প্রাচীন যত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অধিকাংশই শিক্ষানুরাগী হিন্দু জমিদারদের হাতে গড়া। ব্রিটিশ আমলে বাঙালি মুসলমানেরা যখন আধুনিক শিক্ষা থেকে রাজনৈতিক কারণে দূরে ছিল তখন অগ্রসর হিন্দু সম্প্রদায় এ অঞ্চলে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে, সমাজ গঠনে প্রভূত ভূমিকা রাখলেও আজ তাদেরই অপমান অপদস্ত করা হচ্ছে? দেশছাড়া করা হচ্ছে? অথচ ক্ষমতায় জামাত-বিএনপি বা হেফাজত নয়, এদেশের হিন্দু সম্প্রদায় যে দলটিকে অন্ধভাবে ভালোবাসে সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও বিশ্বাসের দল আওয়ামী লীগ! তাই বিস্ময় জাগে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ আদর্শিক জায়গা থেকে ক্রমেই কি বিচ্যুত হচ্ছে? তা না হলে এসব ধর্মীয় সন্ত্রাস ও সহিংসতা সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকার জিরো টলারেন্সে নেই কেন?

0 Comments